Header Ads

ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় - হারিকেন, সাইক্লোন ও টাইফুন

লন্ডভন্ড করে যাওয়া প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রুপ - হারিকেন, সাইক্লোন ও টাইফুন 

পৃথিবী সৃষ্টির পাশাপাশি প্রলয় একই ভাবে বিরাজমান৷ প্রকৃতি যেন ছদ্মবেশ ধারণকারী এক মায়াধিপতি৷ প্রকৃতি তার সৌন্দর্য রূপে যেমন মানব জতিকে প্রভাবিত করে ঠিক তেমনি তার ভয়ঙ্কর রুপে ধ্বংসস্তূপে রূপান্তরিত করে৷ এই ধ্বংসাত্মক রুপ - ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, সুনামি, ঝড় ইত্যাদি৷ এই প্রকৃতিক বিপর্যয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে মানব সভ্যতা দায়ী৷ মানব সভ্যতা যত উন্নত হচ্ছে পরিবেশ তত দূষিত হচ্ছে ফলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে৷ এর জন্য বারবার জনজীবনকে প্রকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হচ্ছে৷ এই রকম একটি প্রকৃতিক বিপর্যয় ঘূর্ণিঝড়৷ এই ক্রান্তীয় ঝড়কে আমার ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন নামে যেমন হারিকেন, টাইফুন, সাইক্লোন ইত্যাদি৷

 ঘূর্ণিঝড় কেন হয় ?

বাযুমন্ডলের সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি৷ সাধারনত কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মধ্যে নিরক্ষীয় অঞ্চল বা ক্রান্তীয় অঞ্চল বিরাজ করে৷ নিরক্ষীয় অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে পৃথিবী পৃষ্ট দ্রুত উত্তপ্ত হয় এর ফলে এই অঞ্চলের বায়ু খুব বেশি উত্তপ্ত হয়ে যায়৷ উত্তপ্ত বায়ু হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠে যায়৷ তখন এই স্থান শূন্যতার সৃষ্টি হয়৷ এই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য মেরু অঞ্চল থেকে ঠান্ডা বায়ু ছুটে আসে ৷ উত্তর গোলার্ধের বায়ু দক্ষিণ দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধের বায়ু উত্তর দিকে অর্থাৎ নিরক্ষরেখা দিকে প্রবাহিত হয়৷ পৃথিবী ঘূর্নমান তাই বায়ু সোজা ভাবে প্রবাহিত হতে পারে না করিওলিস শক্তির (Coriolis force) কারণে৷ তাই ফেরলের সূত্র অনুসারে উত্তর গোলার্ধের বায়ু ডানদিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধের বায়ু বামদিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়৷ এই পদ্ধতিতে বায়ু প্রবাহের এই প্রক্রিয়া চক্রের মতো চলতে থাকে তাই এর ফলে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়৷ এই নিম্নচাপ বাড়তে বাড়তে তীব্র ও অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়৷ নিরক্ষরেখার উপর শক্তির প্রভাব শূন্য তাই ওই অঞ্চলে ঘূর্ণিবাত সৃষ্টি অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও করিওলিস শক্তি কম থাকার কারণে ওই অঞ্চলে অর্থাৎ উভয় গোলার্ধে ০° থেকে ৫° মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয় না৷  দুই গোলার্ধে সাধারনত ১০° থেকে ৩০° মধ্যে ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে৷ তাছাড়াও বায়ুমন্ডলের নিম্ন ও মধ্যে স্তরের আর্দ্রতা বেশি থাকা কারণে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে৷ 

ঘূর্ণবাতের কিভাবে সংগঠিত হয় 
    ঘূর্ণিঝড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে 4টি বৃত্তীয় বলয়ে ভাগ করা যায়। যথা—

(i) প্রথম বলয় : ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রীয় অংশে 10 কিমি 20 কিমি ব্যাসযুক্ত একটি বৃত্তাকার কেন্দ্র থাকে একে "ঘূর্ণবাতের চোখ" বলে। এই অংশে বাতাসের গতিবেগ খুবই কম ও আকাশ পরিষ্কার থাকে।

(ii) দ্বিতীয় বলয় : ঘূর্ণবাতের চোখকে কেন্দ্র করে 50 কিমি - 150 কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত ওই অংশের বায়ুর চাপ ঢাল (Pressure gradient) বেশ খাড়া। তাই বাতাসের গতিবেগ প্রবল এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণও খুব বেশি। তাই এটি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বলয়৷

(iii) এই অংশে বাতাসের গতিবেগ অত্যন্ত বেশি থাকে৷ তবে দ্বিতীয় অংশের গতিবেগর তুলনায় কম তাই এটি বহিস্থ  ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ বলয় । 

(iv) সবচেয়ে শেষের বলয়ে দুর্বল ঝােড়াে বাতাস প্রবাহিত হয়। এই অংশটি ধীরে ধীরে বাইরে স্বাভাবিক চাপ, তাপমাত্রা ইত্যাদির সঙ্গে মিশে যায়৷

সমাপ্তি পর্যায় : শক্তিশালী ঘূর্ণবাত স্থলভাগে প্রবেশ করার পর ভূপৃষ্ঠের ঘর্ষণজনিত বাধার জন্য এর গতিবেগ কমে যায়। স্থলভাগে সমুদ্র থেকে জলীয় বাম্প ও লীনতাপের জোগান কমে বলে ঘূর্ণবাতের শক্তি হ্রাস পায়। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে যায়। নিম্নচাপের কেন্দ্র ক্রমাগত উচ্চচাপে পরিণত হয়। তার সঙ্গে ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রে নিম্নচাপ ধীরে ধীরে উচ্চচাপে পরিণত হয় এবং ঘূর্ণিঝড়ের সমাপ্তি ঘটে। 

 ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের গতিপ্রাবাহ 

    কোনো স্থানের উপর দিয়ে ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত অতিক্রম করবে তা বিভিন্ন ভাবে বোঝা যায়৷ যেমন - 

১) ঘূর্ণবাত যেদিকে অবস্থান করবে বায়ু প্রবাহ সেই দিকে শুরু হবে৷ এর পর ধীরে ধীরে মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয় এবং ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করে৷ 

২) ক্রমশ ঝড়ের গতিবেগ বাড়তে থাকে এবং এক সময় তা চূড়ান্ত রুপ নেয় এবং সেই সঙ্গে বৃষ্টিপাত৷ 

৩) তারপর আবহাওয়া হঠাৎ শান্ত হয়ে যায় অল্প কিছু সময়ের জন্য আকাশ পরিস্কার হয় (অর্থাৎ তখন স্থানটির উপর দিয়ে ঘূর্ণবাতের চোখ অতিক্রম করে)৷

৪) এরপর শুরু হয় বজ্রপাত সহ প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি৷

৫) ঘূর্ণবাত আসার আগে বাতাস যে দিকে প্রবাহিত হয়, ঘূর্ণবাত অতিক্রম করার পর বাতাসের দিক পরিবর্তন হয়ে যায় (বাতাস সম্পূর্ণ উল্টো দিকে প্রবাহিত হয়)৷

হারিকেন, সাইক্লোন, টাইফুন

আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় এলাকার গুলিকে ৭ টি ভাগে ভাগ করেছেন -

·         উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর 

·         উত্তর-পশ্চিম প্রাশন্ত মহাসাগর

·         উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর

·         দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর

·         উত্তর ভারত মহাসাগর

·         দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগর

·         দক্ষিণ-পূর্ব ভারত মহাসাগর

wrold map

 বিভিন্ন স্থানের ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের বিভিন্ন নাম :

    ঘূর্ণিঝড়কে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এই ভাগ তিনটি হলো-
  • ক্রান্তীয় নিম্নচাপ(Tropical depression)  : বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কি.মি.-এর নিচে থাকে।
  • ক্রান্তীয় ঝড় (Tropical storm) : বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কি.মি. থেকে ১১৭ কি.মি. পর্যন্ত।
  • হারিকেন /টাইফুন : বাতাসের গতিবেগ যখন ঘন্টায় ১১৭ কি.মি.-এর বেশি হয়।

 ১। হ্যারিকেনঃ  

উৎপত্তিস্থল – ক্যারাবিয়ান সাগর ও মেক্সিকো উপসাগর
প্রভাবিত অঞ্চল – আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বাংশ ও পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ 
আমেরিকার মায়া সভ্যতার মানুষের কাছে এই দেবতা অনেক ক্ষেত্রেই হুরাখান নামে পরিচিত। অনেকেই মনে করেন এর নাম থেকেই স্প্যানিশ বিকৃত উচ্চারণে তা হ্যারিকেনে পরিণত হয়েছে। ঐই সভ্যতার ইনি ছিলেন একত্রে ঝড়ের, বজ্রপাতের এবং আগুনের দেবতা। মায়া ভাষায় হুরাকান  শব্দের অর্থ একপদবিশিষ্ট দেবতা। 

 

হারিকেন, হ্যারিকেন, Hurricane

 ২। টাইফুনঃ

উৎপত্তিস্থল – চীন সাগর ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর
প্রভাবিত অঞ্চল – চীন, ফিলিপাইন্স দ্বীপপুঞ্জ, তাইওয়ান, কোরিয়া উপদ্বীপ, দক্ষিণ কোরিয়া৷
টাইফুন এই শব্দটির অর্থ হল "প্রচণ্ড বাতাস"৷ এটি একটি চীনা শব্দ টাই-ফেং থেকে এসেছে৷ অবার কারো কারো মতে টাইফুন ফার্সি বা অরবি শব্দ তুফান থেকে এসেছে৷
 

 ৩। সাইক্লোনঃ

উৎপত্তিস্থল – ভারত মহাসাগরের উত্তরাংশ বঙ্গোপসাগর ও আরবসাগর
প্রভাবিত অঞ্চল – ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ইত্যাদি৷ 
সাইক্লোন শব্দটির অর্থ বৃত্ত বা চাকা৷ এটি একটি গ্রিক শব্দ কাইক্লোস থেকে সাইক্লোন শব্দটির উৎপত্তি৷ ১৮৪৮ সালে স্যার হেনরি পিডিংটন তার বই Sailor's horn book for the law of storms (সেইলর'স হর্ণ বুক ফর দ্যা ল' অফ স্টর্মস)এ প্রথম "সাইক্লোন" শব্দটি ব্যবহার করেন৷
 

 ৫। বাগুইওঃ 

উৎপত্তিস্থল – উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর
প্রভাবিত অঞ্চল – ফিলিপাইন্স দ্বীপপুঞ্জ

 ৪। উইলি উইলিঃ 

উৎপত্তিস্থল – দক্ষিণ ভারত মহাসাগর

প্রভাবিত অঞ্চল – অস্ট্রেলিয়া পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমভাগ ৷ 

 ৬। তাইফু:

উৎপত্তিস্থল – উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর

প্রভাবিত অঞ্চল – জাপান উপকূল

 ৭। টর্নেডোঃ

উৎপত্তিস্থল – মিসিসিপি নদীর মোহনা ও মেক্সিকো উপসাগর

প্রভাবিত অঞ্চল– আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বাংশ ও মেক্সিকো 

বাতাসে তীব্রতা অনুযায়ী হারিকেন ঝড়গুলিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয় ১ম ক্যাটাগরি, ২য় ক্যাটাগরি, ৩য় ক্যাটাগরি, ৪র্থ ক্যাটাগরি ও ৫ম ক্যাটাগরি ৷ তৃতীয় ক্যাটাগরি হারিকেন থেকে পঞ্চম ক্যাটাগরি হারিকেন ঝড় গুলির গতিবেগ ঘণ্টায় ১১১ মাইল বা তার বেশি হয়ে থাকে ৷ 

গতিবেগ এর উপর ভৃত্তি করে টাইফুনকে তিনভাগে ভাগ করা হয় ৷ বাতাসের গতিবেগ ৭৩ থেকে ৯১ মাইল প্রতি ঘণ্টায় তাকে টাইফুন বলে ৷ বাতাসের গতিবেগ ৯২ থেকে ১২০ মাইল প্রতি ঘণ্টায় তাকে শক্তিশালী টাইফুন এবং প্রতি ঘণ্টায় ১২০ মাইলের বেশি হলে তাকে 'সুপার টাইফুন' বলা হয়ে থাকে ৷

বাতাসের তীব্রতা ও ধ্বংসক্ষমতা অনুযায়ী বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর (ভারত মহাসাগরের উত্তরাংশ) ঘূর্ণিঝড়কে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়৷ বাতাসের গতিবেগ প্রতি ঘন্টায় ৬২ কিমির কম থাকে তাকে নিম্নচাপ বলা হয়৷ গতিবেগ প্রতি ঘন্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিমি হয় তাকে ঘূর্ণিঝড় বা ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বলা হয়৷ গতিবেগ প্রতি ঘন্টায় ৮৯ থেকে ১১৭ কিমি হয় তাকে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বা সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম বলে৷ গতিবেগ প্রতি ঘন্টায়  থেকে ১১৮ কিমি হয় ২১৯ তাকে ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম বলে৷ এটি হারিকেন গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড়ও বলে থাকে৷ বাতাসের গতিবেগ প্রতি ঘন্টায় ২২০ কিমি বা তার বেশি হয়ে থাকে তখন তাকে 'সুপার সাইক্লোন' বলে৷

 আটলান্টিক মহাসাগর ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের উপর আন্তঃক্রান্তীয় সম্মিলন বলয় অঞ্চল নিরক্ষরেখার খুব একটা দক্ষিণে সরে যায় না বলে এই দুটি অঞ্চলে ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত একপ্রকার প্রায় সৃষ্টি হয়ই না বললে চলে।

 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.