Header Ads

নেশার শেষ পরিনতি || Nesha Sesh Parinati

নেশা জীবন কেড়ে নেয়

পশ্চিমবঙ্গের একটি ছোট গ্রাম, গ্রামে হিংসা, মারামারি, দাঙ্গা কিছুই নেই৷ এখানে শান্তি পূর্ণ ভাবে সবাই বসবাস করে এবং প্রতিটি মানুষ একে অন্যের প্রতি সাহায্য বান৷ এই গ্রামের প্রতিটি মানুষ খুশিতে বসবাস করত৷ গ্রামের চারিদিকে আম, জাম, কাঁঠাল, তাল, খেঁজুর ও ছোট ছোট ঝোপ ঝড়ে সবুজ এক অপরুপ সৌন্দর্য দেখা যায়৷ মাঝে মাঝে বাতাসের সোন সোন শব্দ, পাখির কলরব, বাচ্চাদের চিৎকার সব মিলিয়ে মিশিয়ে যেন এক স্বর্গ৷ গ্রামের এক প্রান্তে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ধুধু মাঠ বিস্তৃত৷ এই মাঠে ফসল ফলিয়ে সেই গ্রামের ও আশেপাশের গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে৷ সেই গ্রামে একটি ছোট পরিবার বাস করত৷ সময়ের সাথে সাথে পরিবারের একজন সদস্যের কারণে প্রতিটি সদস্য বেঁচে থেকেও মৃত মানুষে পরিণত হয়েছে৷

পরিবারে স্বামী স্ত্রী ও তাদের বিধবা মা থাকতেন৷ পরিবারটি ছিল ছোট ও সুখের৷ পরিবারে আসে এক খুশির খবর এক নতুন অতিথি আগমনে সুখবর৷ নতুন পরিবারে প্রথম সন্তানের আগাম বার্তা সবাই আনন্দে মেতে উঠে৷ ফুটফুটে চাঁদের মতো কন্যা সন্তান জন্ম নেয়৷ সন্তানের আগমনে পরিবারের মধ্যে খুশির ঝিলিক খেলে ওঠে৷ তারপর তাদের মনে পুত্র সন্তানের আশা জাগে, কিন্তু সেই আশা পূরণ হতে একটু সময় লাগে৷ পরপর তিনটি কন্যার পর প্রথম পুত্র এই দুনিয়ার আলো দেখতে পায়৷ পুত্র সন্তান আগমনে পরিবারের সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে৷ পরিবারটিতে মোট ৭জন নবীন সদস্য জন্ম নেয় এর মধ্যে পাঁচজন কন্যা ও দুইজন পুত্র সন্তান৷
 
গ্রামটিতে সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল হঠাৎ প্রকৃতির যেন গ্রাম বাসিদের প্রতি রুষ্ট হয়৷ একটানা ১২ বছর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় ফলে ফসলতো হয় না বলেই চলে খাবারের জন্য মানুষ হাহাকার করে৷ কেউ দুই বেলা ঠিক মতো খেতে পেত না তবুও তার হার না মেনে এই প্রতিকূল তার সহিত লড়াই করে গেছেন৷
 
সেই পরিবারের সব সদস্য এক সাথে সঙ্গবদ্ধ হয়ে এই দুর্ভিক্ষের প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠে৷ এই দুর্ভিক্ষের জন্য পরিবারের আর্থিক স্থিতি দিন দিন খারাপ হতে থাকে৷ কারণ পরিবারের একজনের উপর সবাই নির্ভরশীল ছিল এবং পরিবারের সদস্য সংখ্যাও অনেক ছিল৷ পরিবারের প্রথম পুত্র বড় হয়  ও এই পরিস্থিতির বুঝতে পারে৷ বড় ছেলে স্কুলে পড়ত তখন সে পরিবারকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়৷ তাই তার পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণীতে ইতি ঘটে৷ কাজের খোঁজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে৷ কাজের সুযোগ পায় এবং খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করে৷ অল্পদিনের মধ্যেই সে কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠে ও পরিবারক সাহায্য করে৷ এই ভাবে বেশ কিছু দিন চলতে থাকে, তারপর পরিবারের দ্বিতীয় পুত্রও কাজের জন্য দাদার কাছে চলে আসে৷ পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছতা ফিরে আসে৷ ধীরে ধীরে দিদি ও বোনেদের বিবাহ এবং পাকা বাড়ি তৈরি হয়৷ মা-বাবা ছেলেদের কাছ থেকে জোর করে কোন কিছু আদায় করেনি তার নিজের স্বেচ্ছায় যতটুকু দিয়েছে মা-বাবা তাতে আপত্তি করেনি৷ তার জানে যে তাদের ছেলে মেয়েরা কত কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছে৷ এখন তার রোজগার করছে, আমার তাদের কিছুই দিতে পারিনি সেই সখ আহ্লাদ নিজেরা পূরন করুক৷ কিন্তু তার এটা ভুলে গিয়ে ছিল যে এই পৃথিবীতে সব থেকে ভয়ঙ্কর প্রানী মানুষ আর মানুষ কখনও ভালো জ্ঞান বা শিক্ষা দরকার ছাড়া গ্রহন করে না৷ কিন্তু খারাপ কাজ, বদবুদ্ধি অনায়াসে গ্রহন করে৷ সামান্য তৃপ্তির জন্য নিজের শরীরকে কষ্টের মুখে ঠেলে দেয় অনায়াসে৷ সেই রকম বড় ছেলেটিও ক্ষণিকের কিছু খুশি ও মজা পাবার উদ্দেশ্যে মদ্যপান (Drinking) করে৷ প্রথম কষ্ট মনে হলেও কাজের জায়গায় নতুন বন্ধুরা তাকে উৎসাহিত করে সেই উৎসাহে ধীরে ধীরে সে মদ্যপানে আসক্ত হয়৷
Drink
শরীরের কষ্টে তার মজা ও আনন্দ অনুভূতি হয়, এই ভাবে চলতে চলতে এই অনুভূতি গুলো তার কাছে উৎসবের অনুষ্ঠানের সমান মনে হয় তার কাছে৷ বাড়ি বাইরে থাকার জন্য বাড়ির লোক জানতেও পায় না যে তাদের ছেলে এই ভাবে তার জীবনের সুখ অনুভব করছে৷
 
পরিবার খুব খুশি তাদের ছেলে নিজ আয় করছে ও নিজের উন্নতি করছে৷ পরিবার বড় ছেলের বিয়ের কথাভাবে এবং বিয়ের জন্য পাত্রী দেখে৷ পাত্রী সন্ধান পায়, পাত্রী দেখে সবার পছন্দ হয় ও বিয়ের দিন ঠিক হয়৷ সব মেয়েরা তার বাবার কাছে পরী হয় এখানেও তার কোন ব্যতিক্রম ছিলনা৷ রূপে গুনে সব কিছু পরিপূর্ণ, বাড়ি কাজকর্ম দিয়ে সকলকে খুশি করতে পারত কিন্তু চাষির মেয়ে হয়েও তাকে কোনদিন মাঠে কাজে যেতে হয়নি, তাই সে ওই কাজ জানতও না৷ একদিকে তাদের বিয়ের হয়৷ বিয়ের এক বছর পর তাদের ছেলে হয়, সবাই আরও একবার খুশিতে মেতে ওঠে৷ তারপর পরিবারের বড় ছেলেটি নতুন ব্যাবসা শুরু করে৷  ব্যাবসায় প্রথম দিকটায় একটু সমস্যা হলেও তারপর ব্যাবসা ভালোই চলে৷ এই ব্যাবসা করতে করতে বহু মনুষের সাথে পরিচিত ঘটে আবার নতুন বন্ধু তৈরি হয়৷ কেউ যদি প্রকৃত বন্ধু পায় সে তাকে ভালো পথ দেখায়, আর কেউ যদি সময়ে বন্ধু পায় তো তার কাছে আনন্দ, ফুর্তি, উল্লাস এই গুলো মহৎ হয়ে ওঠে৷ পরিবারের কথা এক বারও মনে আসেনা, এরপর মদ্যপান ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পরিবারের সমস্যা শুরু হতে থাকে৷ ব্যাবসা চালাতে বাড়ি থেকে তার স্ত্রীর গহনা একটি একটি করে নিয়ে ব্যাবসা দিতে থাকে কিন্তু ব্যাবসা আর আগের মতো চলে না৷ বাজারে অনেক ধার বাকি পড়ে যায় ও ব্যাবসা বন্ধ করতে হয় এই মদ্যপানের জন্য৷ তার তখন এমন অবস্থা হয় যে স্ত্রীর গহনা ও তার বাবার জমানো টাকা দিয়ে পাওনাদারদের পাওনা মেটাতে হয়৷ পরিবারের আর্থিক অবস্থা আবার আগের মতো হয়ে যায়৷ এতকিছু হবার পরে সবাই আশা করেছিল সে আর মদ্যপান করবে না এই ধারনা ভুল প্রমাণ করে সে নিজেই৷ সে চাষবাস শুরু করে, যে মেয়েটা বিয়ের আগে কোন দিন মাঠে যায়নি এখন তাকে দিনভর মাঠের কাজ ও বাড়ির কাজ করতে হয়৷ তার কাছে করার কিছু ছিলনা তার সন্তানের মুখ চেয়ে সমস্ত দুঃখ কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করে নেয়৷ তাদের সন্তানও বড় হতে থাকে স্কুলে যাওয়া শুরু হয়৷
Driking,
এত পরিমান মদের মধ্যে ডুবে থাকে যে ছেলে টিউশন ফ্রি দেবার টাকা থাকে না৷ বাড়ি থেকে ধান চাল বিক্রয় করে টিউশন ফ্রি দিতে হয়৷ এই ভাবে চলতে থাকে দিনের পর দিন, ছোট ছেলেটি বড় হতে থাকে ও বুঝতে শিখে৷ তারপর ওই ছেলেটি ধীরে ধীরে বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয় কারণ আশেপাশের লোকের জিজ্ঞাসা করে যে তোর মাতাল বাপ কি করছে আর হাসাহাসি করে৷ ছেলেটি লজ্জা, অভিমান, রাগে বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়, খুব প্রযোজনা ছাড়া যায় না৷ একদিন মদ্যপান করে বাড়িতে অশান্তি পূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে তখন ওই ছেলেটি রাগে বাড়ির ছেড়ে চলে যাওয়ার সিন্ধান্ত নেয়৷ ছেলেটি ঠাকুমা ও প্রতিবেশীর লোকের কোন রকমে আটকায়৷ ছেলেটি মনে মনে ঘৃণা জমতে থাকে, সে তার বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়৷ কোন এক কারণে ওই ছোট ছেলেটির সাথে তার বাবার তর্কবিতর্ক হয় তখন ছেলেটিকে বলে যে তুই মরে গেলেও আমার কোন দুঃখ নেই, তুই কে তোকে চিনিনা৷ ছেলেটি তখন কি করবে বুঝতে পারেনা সে তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, বাড়ি থেকে কোথায় যাবে কার কাছে যাবে সে কিছুই ভাবতে পারে না৷ সেই মূহুর্তে তার  মনের মধ্যে যে যন্ত্রণা সৃষ্টি হয় তা বলার মতো নয় কিন্তু সেই মূহুর্তে কিছু করার ছিল না তার৷ সে স্বপ্নেও ভাবে না তাকে এই রকম কথাশুনতে হবে, ছেলেটি তাকে কবে বাবা বলে ডেকেছে তা হয়তো কারো মনে নেই৷ এই কথাটা ছেলেটির মনে গভীর ভাবে প্রভাব ফেলে৷ ছোট ছেলেটি বাড়ির কোনে একা থাকতে শুরু করে এই ব্যাক্তির নেশা করার পরিধি যত বাড়তে থাকে ছেলেটির সখ, আহ্লাদ, আনন্দ ইত্যাদির পরিধি তত ছোট হতে থাকে৷ একসময় বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয় কারণ তাকে আশেপাশের লোকেদের মন্তব্য শুনতে না হয় সেই জন্য৷ ছেলেটি রাতে ঘুমাতে পারতনা দুই চোখের পাতা এক করলে এই সব স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে প্রতি রাত কেটেছে চোখের জল ফেলে৷ পূর্জা-পার্বনেও ছেলেটিকে হাসিখুশি দেখতে পাওয়া যেত না৷ ছেলেটির মনে তার বাবার প্রতি প্রেম ভালবাসা কিছুই ছিল না৷ কেউ কোন দরকারে বাড়িতে এসে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলে যে তোর বাবা কোথায়? উত্তর দেয় জানিনা অথবা চিনিনা অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করে নিন৷ কেউ যদি কোন কারণে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করত তোমার বাবার নাম কি? ছেলেটি উত্তরে বলত আমার ঠাকুরদার নাম উমুক কিন্তু বাবার নাম বলত না৷ এই ভাবে চলতে থাকে বছর কয়েক, ছেলেটি কলেজ শেষ করে, একটি কোম্পানিতে কাজ শুরু করে৷ শুরু হয় তার পথ চলা৷ কোন দরকার ছাড়া ছেলেটি বাড়ি আসত না ছোট বেলা থেকে বাড়ি তার কাছে একটি ভয়ঙ্কর স্থান৷ ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে তবুও মদ্যপানের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে৷ কেউ বলতে পারেনা কবে মদ্যপান করা কমবে বা বন্ধ হবে৷ এত কিছুর পরে কোন ব্যাক্তির জীবনে পরিবর্তন আসে, সেটা মনে হয় এই জীবনে আসবে না৷ এতদিনে কি করেছে, কি পেয়েছে এই জীবনে? 
জীবনের মূল আধার প্রেম, ভালবাসা সব কিছু থেকে বঞ্চিত রইল৷ কারো কাছে থেকে সম্মান, একটু ভালবাসা, পরিবারের খুশি কিছুই পেলনা, পেল শুধু বিষাক্ত জল যেটা মানুষের শরীরকে একটু একটু করে শেষ করছে এবং তার পরিবারকে সমাজের এক কোনে আবদ্ধ করছে৷ 
 
নেশা সেই পথ যা কিছু পায় তার থেকে 
বেশি কিছু ধ্বংস করে যায় ||

এই নেশা ছোট ছেলের জীবন থেকে কেড়ে নিল সারা জীবনের জন্য বাবার প্রতি প্রেম, ভালবাসা, বিশ্বাস, জীবনে শেষে হয়ে গেল হাসি, আনন্দ, বাবার স্নেহ৷ একটা ছোট বাচ্চা ছেলের জীবনে এমন এক প্রলয় যা কেউ কোন দিন তার ক্ষতি হিসাবে করতে পারবে না৷ তাই প্রতিটি বাবা-মা কাছে আমার অনুরোধ তাদের সন্তানের জীবন নিজেদের খুশির জন্য শেষ করে দিও না! সন্তানের কাছে তার বাবা-মা এক অমূল্য সম্পদ যার তুলনা হয় না৷
 
যে কোন পুরুষ বাবা হতে পারে কিন্তু 
একজন দ্বায়িত্ববান বাবা হতে গেল কিছু 
বিশেষত্ব থাকা দরকার ||

বাবা মানে একটু ভালবাসা, একটু বকুনি, প্রকৃত হিরো, এগিয়ে চলার পথের দিশা, হেরে গিয়ে উঠে দাঁড়ানোর সম্বল
 

সব আশা রয়ে গেল কিছু পূরন হল না !

এই নেশা কেড়ে নিয়ে গেল জীবনের সেরা মূহুর্তগুলো৷


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.